দখিনের খবর ডেস্ক ॥ ২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারি করতে অস্বীকৃতি জানালে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হোসেন আলীকে সিলেটে বদলি করে মি. কোরায়েশিকে ঢাকায় আনা হয়। সকালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি গোলাম মওলার পরামর্শে জিএস শরফুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে একটি দল পুরান ঢাকার কাদের সর্দারের বাসায় গিয়ে তাঁকে বুঝিয়ে ভাষা আন্দোলনের পক্ষে কাজ করার প্রতিশ্রুতি আদায়। ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের ব্যাপকতায় মুখে নুরুল আমীন সরকার ঢাকা শহরে এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জরি করেন। সরকারের পক্ষে ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এস.এইচ. কোরেশি সমগ্র ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারির নির্দেশ প্রদান করেন। এদিকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ২১ ফেব্রুয়ারি সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী সাধারণ হরতাল, বিক্ষোভ ও সভা-সমাবেশের ব্যাপক প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। সৃষ্টি হয় এক অভাবনীয় গণচেতনা। ১৪৪ ধারা জারির প্রেক্ষিতে ২১ ফেব্রুয়ারির কর্মসূচীর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় এক বৈঠক বসে। ৯৪, নওয়াবপুর রোডে আওয়ামী মুসলিম লীগের অফিসে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ এই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রবীণ নেতা আবুল হাশিম। উক্ত বৈঠকে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে বিপক্ষে ভোট গ্রহণ করা হয়। বেশিরভাগ সদস্য ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার বিপক্ষে ভোট দেয়। সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়, ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ এ সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি। পরে সিদ্ধান্ত হয় বিষয়টি ২১ ফেব্রুয়ারি আমতলার সভায় নির্ধারিত হবে। সংগ্রাম পরিষদের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার সিদ্ধান্তে ছাত্রদের মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে যায়। রাত বাড়তে থাকে উত্তেজনাও বাড়তে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের হোস্টেল ব্যারাক উত্তেজিত ও প্রতিবাদী ছাত্রদের পদচারনায় মুখরিত হয়ে ওঠে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা মেডিক্যাল ব্যারাকে অনুষ্ঠিত এক ঘরোয়া সভায় ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার ব্যাপারে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৪৪ ধারা জারির পর পরই ছাত্রসমাজের মধ্যে দারুণ উত্তেজনা ও ব্যাপক কর্মতৎপরতা লক্ষ্য করা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্ররা সভা করে সরকারের এই ঘোষণার তীব্র প্রতিবাদ জানান। বিশেষ করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার বিরুদ্ধে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত ছাত্রাবাসগুলোতে পৌঁছলে নতুনভাবে উত্তেজনার সৃষ্টি হয় এবং সারারাত ধরে ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার সমর্থনে পোস্টার লেখাসহ অন্যান্য প্রচার কার্যে ব্যস্ত থাকেন। ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যেই সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ এবং বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে একটি করে প্রচার পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের পুস্তিকাটির নাম ছিল ‘আমাদের ভাষার লড়াই’। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক কাজী গোলাম মাহবুবের অনুরোধে বদরুদ্দীন উমর কর্তৃক এটি লিখিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের পুস্তিকাটির নাম ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা কি ও কেন।’ যুবলীগের উদ্যোগে এবং অলি আহাদের অনুরোধে পুস্তিকাটি রচনা করেন আনিসুজ্জামান। ২০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ তারিখে গভীর রাতে ঢাকা হলের (বর্তমানে শহীদুল্লাহ হল) পুকুর পাড়ে ১১ ছাত্রনেতা এক গোপন বৈঠকে মিলিত হয়ে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেন। এই বৈঠকটি নিয়ে ভাষাসৈনিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই আমতলায় ছাত্রজনতা জমায়েত হতে থাকে। বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে নেতৃবৃন্দ সমাবেশস্থলে উপস্থিত হন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমতলা ও মধুর ক্যান্টিন ছাত্রদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের (আজকের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের জরুরী বিভাগ) আমতলায় সকাল ১১টায় শুরু হয় ঐতিহাসিক ছাত্রসভা। সভায় সভাপতিত্ব করেন গাজীউল হক। সভাশেষে আবদুস সামাদ আজাদের প্রস্তাবক্রমে সিদ্ধান্ত হয় যে, ১০ জন করে সত্যাগ্রহ করা হবে। অর্থাৎ ১০ জনের একটি দল পর্যায়ক্রমে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ভাষার দাবিতে স্লোগান দিয়ে পরিষদ ভবনের দিকে অগ্রসর হবে। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। ছাত্রছাত্রীরা ‘১৪৪ ধারা ভাঙ্গতে হবে’, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ইত্যাদি ধ্বনিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ প্রকম্পিত করে তোলে। ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী ছাত্রদের নামের তালিকা তৈরি করেন মোহাম্মদ সুলতান। তাছাড়া হাসান হাফিজুর রহমান ও কাজী আজহার এ দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গ বিধান পরিষদের অধিবেশন ছিল তিনটায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়াল ভেঙ্গে ছাত্ররা পরিষদ ভবনে যাওয়ার উদ্দেশ্যে আমতলা থেকে বেরিয়ে ‘চলো, চলো, এ্যাসেম্বলী চল’ বলে মেডিকেল ব্যারাকে সমবেত হয়। প্রতিবাদী ছাত্রও পুলিশের সঙ্গে শুরু হয় খ- যুদ্ধ। পুলিশের প্রতি ছাত্রদের ইট-পাটকেল নিক্ষেপ ও পিকেটিং অব্যাহত থাকে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের কন্ট্রোল রুম থেকে চলতে থাকে জ্বালাময়ী বক্তৃতা। সম্পূর্ণ বিনা কারণে ছাত্রজনতাকে লক্ষ্য করে বেলা ৩টা থেকে ৩.৩০ মিনিটের মধ্যে ২৭ রাউন্ড গুলিবর্ষণ করা হয়। গুলিতে রফিক উদ্দিনের মাথার খুলি উড়ে যায় এবং ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বরকতের উরুতে গুলি লাগে। তাঁকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অপারেশন করেও বাঁচানো সম্ভব হয়নি। গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন আব্দুল জব্বার। এ পর্যন্ত প্রাপ্ততথ্য থেকে ২১ ফেব্রুয়ারিতে এই তিনজন ভাষা শহীদদের পরিচয় পাওয়া যায়। তবে ভাষা শহীদদের সংখ্যা যে তিনের অধিক ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। ভাষাসৈনিকদের স্মৃতিচারণ, পত্রিকার বিবরণ থেকেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়। তৎকালীন সরকার অনেক ভাষা শহীদদের মরদেহ গুম করে ফেলা হয়েছিল। ফলে অন্যদের কোন পরিচয় এমনকি কবরেরও সন্ধান পাওয়া যায়নি। গুলিবর্ষণের পর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ লোকে-লোকারণ্য হয়ে যায়। ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচী ও কার্যক্রমের পীঠস্থান ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের তীর্থকেন্দ্রে পরিণত হয় মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল ব্যারাক। রাতে অলি আহাদের উদ্যোগে ৪ নং ব্যারাকের ৩ নং কক্ষে অনুষ্ঠিত আরেকটি সভায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ছাত্র সংসদের তৎকালীন ভিপি গোলাম মাওলাকে আহ্বায়ক করে একটি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। উক্ত পরিষদ পরদিন গায়েবানা জানাজা ও শোক মিছিলের কর্মসূচী ঘোষণা করে। ২১ ফেব্রুয়ারি গুলিবর্ষণের এক ঘণ্টার মধ্যে রেডিও শিল্পীদের ধর্মঘট পালিত হয়। সন্ধ্যায় এসএম হলে ছাত্রদের প্রতিবাদসভা অনুষ্ঠিত হয়। রাতে যুবলীগের অফিসে পুলিশ তল্লাশি করে। সরকার ১৪৪ ধারা জারির পাশাপাশি রাত ১০টা থেকে পরদিন ভোর ৫টা পর্যন্ত সান্ধ্যআইন জারি করে। একুশের হত্যাকা-ের খবর শুনে প্রথম কালো ব্যাজ ধারণ করেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। গভীর রাতে একুশের শহীদদের স্মরণে রাজশাহী কলেজে নির্মিত হয় প্রথম শহীদ মিনার। গুলিবর্ষণের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হাসান হাফিজুর রহমানের উদ্যোগে প্রকাশিত হয় লিফলেট এবং আলাউদ্দিন আল আজাদের উদ্যোগে প্রকাশিত হয় বুলেটিন। দৈনিক আজাদ ‘ঢাকার রাজপথ রক্তে রঞ্জিত’ শিরোনামে একটি টেলিগ্রাম প্রকাশ করে। পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির পূর্ববঙ্গ সংগঠনিক কমিটি একটি ইশতেহার প্রকাশ ও প্রচার করে। প্রথম কবিতা রচনা করেন চট্টগ্রামের মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কর্মসূচী অনুযায়ী ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বাইরে পূর্ববাংলার সর্বত্র ধর্মঘট, সভা, বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। ২১ তারিখে সরকার একটি প্রেসনোট জারি করে পত্রিকা অফিসে পাঠায় এবং এতে ছাত্রহত্যার কোন কথা উল্লেখ করা হয়নি। গভীর রাতে সংগোপনে ভাষা শহীদদের মরদেহ দাফন করা হয় আজিমপুর কবরস্থানে। কবরস্থান থেকে রক্তাক্ত বস্ত্র উদ্ধার ও কবর শনাক্ত করেন আলী আহসান এবং খোন্দকার মোহাম্মদ আলমগীর।
Leave a Reply